শাকের আহমেদঃ
মা চলে গেল, এই জন্য আমার কোন আপসোস নেই। কারণ আমি বিশ্বাস করি, এই সিদ্ধান্ত আসমান থেকে আসে। দশ জনের মা চলে গেছে, আমার মা ও চিরদিন থাকবে না, সেটা আমিও জানতাম। সেইজন্য আমার বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই। কিন্তু দেশীয় অনাচার, অযাচার আর নীতিহীনতার যাতাকলে মরিচের মত পিষ্ট হতে হতে মায়ের চলে যাওয়া দেখে আমি আমার বেঁচে থাকাকে অনর্থক মনে করছি। নবী ঈসমাইল (আঃ) এর মা বিবি হাজেরা যেমন তার সদ্য ভূমিষ্ট শিশুপুত্র ঈসমাইল কে এক ফোঁটা পানি পান করানোর জন্য আরবের মরুপ্রান্তরে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝখানে সাতবার দৌঁড়াদৌঁড়ি করেছিল, তেমনি আমিও আমার চরম হতভাগিনী মাকে বাঁচানোর জন্য একফোটা সু চিকিৎসার আশায় কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ঢাকায় বিরামহীন দৌঁড়াদৌঁড়ি করেও এক ফোঁটা সুচিকিৎসার অভাবে প্রাণবন্ত, হাসিখুশি মাকে ঢাকা নিয়ে মাত্র ৫ দিনের মাথায় প্যাকেট করে বাড়িতে এনে হিমশীতল মাকে চিরদিনের জন্য রোপন করে দিয়েছি।
পার্থক্য একটাই, বিবি হাজেরার দৌঁড়াদৌঁড়িতে চিরদিনের জন্য আল্লাহ যমযম কুপের সৃষ্টি করে দিয়েছেন, কারণ তিনি নবীর মা। আর আমার দৌঁড়াদৌঁড়িতে আল্লাহ আমার কলিজার ভিতরে একটি গরম রক্তের নদী সৃষ্টি করে দিয়েছেন। কারণ আমি পাপী।
তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমার ঐ রক্ত নদী হতে উদগিরিত গরম বাষ্প গরম নিশ্বাস হয়ে বের হয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে মারাত্নক মারলাস্ত্রের আকার ধারণ করে আঘাত করবে ঐ নীতিহীন মানুষগুলোকে, যারা একজন মায়ের জীবনের চেয়ে নিজের পকেট ভর্তি করাকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। যারা সমালোচনার ভয়ে রাস্তায় আমার মূমুর্ষ মাকে বহনকারী অটোরিক্সাকে ট্রাফিক সিগন্যাল হতে ছাড় দিতে পারেননি। যারা অহংকারের মোড়ক হতে বের হয়ে আমার মা কি রোগে আক্রান্ত, সে সংবাদ আমাকে জানাতে পারেননি। হয়ত তার কয়েক সেকেন্ড দেরি হবে, বাইরে অর্ধশত রোগি ভিজিট হাতে অপেক্ষমান আছে। ঐ কড়কড়ে টাকার সুগন্ধের কাছে আমার মায়ের জীবন তার কাছে নস্যি।
গত ১৪/২/২১ তারিখে সামান্য জ্বর আর পা ফোলা সমস্যা নিয়ে আমি আমার মাকে ককসবাজারের বিখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ফরহাদ এর কাছে নিয়ে যাই। তিনি ৮/৯ হাজার টাকার টেস্ট করিয়ে জানান, মায়ের ফুসফুসে সমস্যা আছে। উনার কথামত আমি মাকে ইউনিয়ন হাসপাতালে ভর্তি করাই।
কয়েকদিন পর আবার ৩/৪ হাজার টাকার টেস্ট করিয়ে জানান, এখন ভাল, ঔষুধ দিল বাসায় নিয়ে এলাম। ৩দিন পর মায়ের ব্যাপক শ্বাসকষ্ট শুরু হলে আবার তার কাছে নিয়ে যাই। তিনি আমাকে ককসবাজারের অতি বিখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ লুৎফুন্নাহার এর কাছে রেফার করেন। অতি কষ্টে মৌচাকের মত রোগীর ভীড়ে সিদ্ধ হয়ে এক পর্যায়ে তার কাছে মাকে নিয়ে গেলে তিনি ২/৩ সেকেন্ড আমার মাকে দেখে আবার পূর্বের মাত্র ৩ দিন আগে করা সমস্ত টেস্টসহ আরো কিছু টেস্ট করে আনতে বলেন।
আমি তাকে বিনিতভাবে জিজ্ঞাসা করি, ম্যাডাম আমার মায়ের সমস্যাটা কি? তিনি আমার কথাকে পাত্তাই দিলেন না।
বলে দিলেন, বাবা এত কিছু বলা যাবে না, ঔষুধ দিয়েছি সেগুলো খাওয়ান। আমাকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অন্য রোগী দেখা শুরু করেন।
পরের দিন আবার ৮/৯ হাজার টাকার টেস্ট করিয়ে রিপোর্টসহ আমি ড্রেস পরিহিত অবস্হায় তার চেম্বারে গিয়ে আমার পরিচয় দিয়ে বলি, ম্যাডাম কালকে আপনার অমুক আচরনের শিকার রোগিটা আমার মা।
তিনি বললেন, গতকাল আমি তাড়াহুড়া থাকায় আপনার মাকে ভাল করে দেখতে পারিনি। আজকে কি রোগিকে নিয়ে এসেছেন? বললাম না। তারপর তিনি রিপোর্ট গোলো দেখে জানালেন, “আপনার মায়ের হার্টে কিছুটা সমস্যা আছে, কিন্তু সামান্য এই সমস্যার কারণে উনার অবস্থা এত খারাপ হওয়ার কথা নয় তারপরও এই ঔষুধগুলো খাওয়ান।” এই বলে মোট ১৩ প্রকার ঔষুধ দিলেন।
আমি বিফল মনোরথে তার চেম্বার থেকে বের হয়ে কিংকর্তব্যবিমোঢ় হয়ে পড়ি। মাকেসহ আবার গেলাম আরেক হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ আব্দুস সালামের নিকট।
তিনি বললেন, মায়ের ফুসফুসে পানি আছে। আল ফুয়াদ হাসপাতালে ভর্তি করতে বললেন। আমি ভরসা পেলাম না। উপায় না দেখে উপরের ১৩ প্রকার ঔষুধ কিনে এক সপ্তাহ খাওয়ালাম। মায়ের কোন ইমপ্রুফ হল না। তারপর মাকে নিয়ে গেলাম চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের রেসপিরেটরি মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধান ডাঃ সরোজ কুমার চৌধুরির কাছে। আগে সিরিয়াল না দিয়ে যাওয়ায় সন্ধ্যা ৭টা হতে রাত ১২ টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে ১২.১০ টার সময় তিনি গ্লাসের আড়াল হতে মাত্র কয়েকদিন আগের টেস্ট রিপোর্টগুলো ৫ সেকেন্ড চোখ বুলিয়ে আবার একই টেস্ট ও সিটিআরটি সহ প্রায় ৪৫ হাজার টাকার টেস্ট দিলেন। দ্রুত টেস্ট করিয়ে রিপোর্ট নিয়ে গেলাম তার কাছে। তিনি মাত্র কয়েকটা রিপোর্টে কয়েক সেকেন্ড চোখ বুলিয়ে মাকে ৫/৬ টি ঔষুধ দিয়ে বিদায় দিলেন। ৭ হাজার টাকার সিটিআরটি পরীক্ষার রিপোর্টটি তিনি দেখলেনই না। অথচ সেই রিপোর্টেই আমার মায়ের সমস্যা নিহিত ছিল।
যাই হোক, কি সমস্যা জিজ্ঞাসা করলে জানান, ফুসফুসে ইনফেকশন। তার কথা মত আমি অন্য একজন ডাক্তারের কাছে মাকে নিয়ে গেল ঐ ডাক্তার মায়ের ফুসফুস হতে কিছু ফ্লুইড বের করলে মা আরাম বোধ করেন। মাকে নিয়ে আবার গেলাম একই রোগের বিশেষজ্ঞ ডাঃ জনাব কিবরিয়ার কাছে। তিনি একটি ঔষুধ যোগ করলেও আমার মায়ের কোভিড হওয়ার বিষয়টি সন্দেহ করেন। কিন্তু কোন চিকিৎসা দিলেন না। আমি মাকে বাড়িতে নিয়ে আসলাম। মা দু’একদিন আরামবোধ করলেন। আমি যেন আকাশের চাঁদ শুধু নয়, পুরো আকাশটাই যেন হাতে পেলাম। কিন্তু ২ দিন পর মা এর শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে আমি মেরিন সিটি হাসপাতালে ১ রাত অক্সিজেন দিয়ে রেখে। তারপর কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে অত্যন্ত সীমিত সুযোগ সুবিধা, পঁচাগলা পরিবেশ, অনেক দূরে ব্যবহার অনুপযোগী টয়লেট, আর নার্স নামের কিছু হিংস্র উটতি বয়সী মহিলাদের সতীনি আচরণ দেখে আমি হতভম্ব। আমার মা এক মূহূর্ত সেখানে থাকতে চান না। রোগি যেন তাদের এক নম্বর শত্রু। মায়ের চিকিৎসার কোন বিষয়ে তাদের সাথে কথা বলতে গেলে খারাপ ব্যবহারের ভয়ে গলা শুকিয়ে যায়। মাকে রক্ত দেয়ার জন্য রক্তের ক্রসম্যাচিং এর জন্য কর্তব্যরত নার্সকে মার শরির হতে কয়েক ফোঁটা রক্ত নিয়ে দিতে বললে নার্স কিছুতেই দেবেনা। এটা নাকি তার কাজ নয়।
আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞাসিলে ডাক্তার জানান, এটি ঐ নার্স এর কাজ। কারপর তাকে বললাম। আপনি রক্ত না নিয়ে দিলে আমি আপনাকে টেনেহিচড়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। তখন সে রক্ত নিকে গিয়ে মাকে ইচ্ছাকৃত কষ্ট দিচ্ছিল।
আমি জিজ্ঞাসা করলে জানায়, রক্ত আসছে না। আমি বললাম, সিরিঞ্জ আমার হাতে দেন। তখন সে নড়ে চড়ে বসে এবং রক্ত নিয়ে দেয়। হাসপাতাল হতে সরবরাহকৃত রোগির এটেন্ডেন্ট কার্ড থাকার পরও আমার ভাগ্নিকে গেইটের দারোয়ান ঢুকতে দেয় না। ধাক্কা দেয়। আরো বলে, এখন ধাক্কা দিয়েছি, আবার ঢুকতে চাইলে গায়ে হাত দেব। যারা বকশিস দিচ্ছে তাদের ঢুকাচ্ছে।
দুর্ভাগ্যক্রমে ভাগ্নির হাতে বকশিস দেয়ার মত যথেষ্ট অর্থও ছিল না। পরে আমি ৬ কিলোমিটার দুরের বাসা হতে ১০০ কিলো স্পীডে গাড়ী চালিয়ে হাসপাতালে গিয়ে ভাগ্নিকে মুমুর্ষ মায়ের বেডের পাশে ঢুকিয়ে দিই। হুইল চেয়ার ব্যবহারেও ২০০/৩০০ টাকা বকসিস। আর হুইল চেয়ার পাওয়া যেন হাতে চাঁদ পাওয়া। হুইল চেয়ার না পেয়ে এবং মানুষে ঠাসা লিপ্টে মা দাঁড়িয়ে থাকতে না পারায় কতবার যে কোভিডসহ বিভিন্ন টেস্টের জন্য মাকে কোলে কাঁধে করে ৪ তলায় উঠানামা করেছি! যা হোক, অনেক কষ্টে একটি কেবিন ম্যানেজ করি। সেজন্য আরএমও ডাঃ শাহিন আব্দুর রহমান চৌধুরির নিকট আজীবন কৃতজ্ঞ। ডাক্তার জগতে এই নিরহংকার লোকটিকে আমি প্রচন্ড ভালবাসি। তবে কক্সবাজার সদর হাসহাতালের ইন্টার্নি ডাক্তার গণের ব্যবহার খুবই সন্তোষজনক আর সেবা প্রদানে তারা শতভাগ আন্তরিক। শুধু নার্সদের ব্যবহার আর আন্তরিকতা শূন্যের কাছাকাছি।
অনেকটা মনে পড়লে গা শিউরে উঠে। ১ সপ্তাহর চিকিৎসার পর কোন ইমপ্রুভ না হওয়ায় আমি সিদ্ধান্ত নিই, মাকে ঢাকা নিয়ে যাব। আমি জানতাম না সেখানে আমার আর মার জন্য একটি মিনি কারবালা ময়দান মহান আল্লাহ প্রস্তুত করে রেখেছিল।
২২ মার্চ সকাল ১১ টায় আমার মা নিজে হেঁটে আমার ফ্যামেলির লোকজনসহ আমার বাসা হতে এয়ারফোর্টে যাওয়ার জন্য গাড়ীতে উঠেন।এ সময় আমি দুষ্টুমি করে বলি, মা ঢাকা হতে আল্লাহর হুকুম থাকলে হয়ত তোমাকে সুস্হ করে আনব, নইলে মরা আনব। সুস্হ না হয়ে হুট করে চলে আসতে পারবে না। মা মুচকি হাসেন। সদ্য গোসল করে বেগুনি রঙ এর একখানা শাড়ী পরা মাকে খুব সুন্দর লাগছিল। আমি আড়ালে থেকে মা কে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিলাম। জনাব, আজরাইল হয়ত তখন আমার বাসা হতে টগবগে তরুনীর ন্যায় চিরদিনের জন্য চলে যাওয়া মাকে দেখে আসমানে বসে অট্টহাসি দিচ্ছিল। যা হোক, বিমানে উঠে অনেক কথা হল। মা বিমানের জানালা দিয়ে নিচের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগল। মা পান খেতে চাইল।
বললাম মা, পান তো নিচের বেল্টে দেয়া ব্যাগে রেখে দিয়েছি। আরো বললাম, মা অসুখটা ভাল হলে তোমার পুরাতন সব দাঁত ফেলে দিয়ে দুই পাটি নতুন, সুন্দর আর কৃত্রিম দাঁত লাগিয়ে দেব। তখন বেশি করে পান খেও। আর ককসবাজার মেগা মার্ট হতে তোমাকে শাড়ি কিনে দেব। মা মুচকি হাসেন। ঢাকা এয়ারপোর্টে পৌঁছে ইউএস বাংলার এ্যাম্বুল্যান্সে করে মাকে গেইটে নিয়ে আসি। দেখি ঢাকার তাপমাত্রা ৩৪ ডিগ্রি সেঃ। সেখান থেকে মাকে পূর্ব নির্ধারিত বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে নেয়ার জন্য অটোরিক্সা ভাড়া করি। গাড়িতে উঠে নৌসদর দপ্তরের সামনে এসে দেখি ১ কিলোমিটারজুড়ে তিব্র যানজট। প্রচন্ড গরম আর যানজটে মা ছটপট করতে লাগল। আমি ফু দিয়ে মা কে বাতাস করি। প্রায় এক ঘন্টা পর যানজট কমল। মহাখালি এসে আবার, ফার্মগেট এসে আবার, শাহবাগ এসে আবার। ততক্ষণে মা সিদ্ধ হয়ে গেছে। ২.৫ ঘন্টা পর পিজিতে এসে ভিসি মহোদয়ের পিএস পলাশ ভাই এর সামনে হাজির হয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে মাকে ভর্তির অনুরোধ করি। তখন মাকে নিচের ফুটপাতে বসিয়ে রেখে এসেছি। তিনি ঐ দিনের মত ক্ষমা চাইলেন। পরদিন ৮ টায় আসতে বললেন। আমি মাকে রাখার আর কোন হোটেল খুঁজে পাই না। হয় ৪/৫ তলায় রুম পাওয়া যায়, কিন্তু লিপ্ট নেই। ফকিরাপুল এসে অনেক খোঁজে একটি লিপ্ট সমৃদ্ধ হোটেল পাই। মা এর চেহারায় স্বস্হি দেখতে পেলাম। যা খেতে মন চায়, তাই কিনে আনি, কিন্তু মা খেতে পারে না। জোর করে এক লোকমা খাওয়ালেও ২/৩ বার বমি করে দেয়। মা রাত্রে ঘুমাতে পারল না। শুলেই নিঃশ্বাস আটকে যায়। মা বসে আছে। ৩ সপ্তাহের শারীরিক মানসিক পরিশ্রমে কাতর আমি স্বার্থপরের মত কিছুক্ষণ ঘুমাই। সকালে মাকে নিয়ে চলে যাই আবার পিজিতে পলাশ ভাই এর কাছে। তিনি হেল্পফুল হয়ে তার সহকারীর মাধ্যমে আমাকে কার্ডিও সার্জন প্রফেসর ডাঃ মোসতাফিজুর রহমানের নিকট পাঠায়। আমার মায়ের কোভিড নেগেটিভ রিপোর্ট দেখানোর পর তিনি মাকে ভালভাবে পরীক্ষা করে আমাকে পরিষ্কার করে বললেন “বাবা তোমার মায়ের হার্টের দুটি ভাল্ব নষ্ট।”
আমি তাকে বললাম, স্যার, আপনার কাছে আসার আগে আমি ৭/৮ জন বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখিয়েছি। কেউ আমাকে ভাল্ব নষ্ট কথাটা বলেনি। তিনি আপসোস করলেন।
আমি তাকে বললাম স্যার, ঐ ডাক্তাররা কেউ যদি আমাকে ভাল্ব নষ্ট বলত, তাহলে ককসবাজার- চট্টগ্রামে দেড়মাস দৌঁড়াদৌঁড়ি না করে মাকে ঢাকা এনে অপারেশন করিয়ে ভাল্ব চেঞ্জ করাতাম। কিন্তু তারা কেউ আমাকে বলেছেন মায়ের ফুসফসে ইনপেকশন, কেউ বলেছে, পানি জমেছে। কেউ বলেছে কোভিড হয়েছে। কেউ কেউ কিছুই বলেনি, এমন কি জানতে চাইলেও না।
তিনি বললেন, ভাল্ব নষ্ট হওয়ার কারণে ফুসফুসে পানি জমতেই পারে। কিন্তু উনার মুল সমস্যা ভাল্ব। তোমার ডাক্তাররা মুল সমস্যার চিকিৎসা না করে অন্য রোগের চিকিৎসা করেছেন। আর এখন তোমার মাকে অপারেশন করার অবস্হা নেই। দেড়মাস তুমি ভুল পথে হেঁটে তোমার মাকে এখানে এনেছ। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। বললাম এখন উপায় কি স্যার? তিনি মিরপুর ১০ এ ডাঃ কবিরুজ্জামানের কাছে গিয়ে একটি ইকো করে অন্য কোথাও ভর্তি করে মাকে অপারেশন সক্ষম করার পরামর্শ দেন। আমি হতোদ্যম হয়ে মাকে নিয়ে মিরপুর ১০ এ রওনা দিই। ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তায় যানজট। মা আবার সিদ্ধ হতে লাগল। আবার ছটপট। পথে শশা বিক্রি করতে দেখে মা কাকুতি মিনতি করে বলল, বাবা আমার শরীরটা পুড়ে যাচ্ছে। কলিজাটা শুকিয়ে গেছে। আমাকে একটা শশা কিনে দাওনা। আমি নিষ্ঠুর হতভাগা ডাক্তারের সিরিয়াল পাব না এই ভয়ে আর ঢাকার রাস্তায় হুট করে যেখানে সেখানে গাড়ি থামানোর সুযোগ না থাকায় আমি মাকে শশা খাওয়াতে পারলাম না। চিন্তা করলাম, অসুখ ভাল হলে মাকে কত শশা খেতে চায় খাওয়ানো যাবে। আগে ডাক্তারের সিরিয়াল।
মিরপুর-১০ এ গিয়ে সেই ডাক্তারের সিরিয়াল আগামী এক সপ্তাহর ভিতরে নেই। পরিচয় দিলাম। তদবির করলাম, বড় ফোন করালাম কাজ হল না। সর্বোচ্চ ৩ দিন এগিয়ে এসে সিরিয়াল দিতে রাজি হল। কিন্তু আমার মা যে অন্তিম অবস্হায়, ৩ দিন কি অপেক্ষা করা সম্ভব? অতঃপর আমি আবার প্রচন্ড গরমে মাকে নিয়ে রওনা দিলাম ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে। সেখানে গিয়ে হাসপাতালে সিট খালি না থাকায় এবং কোভিড সন্দেহ করে মাকে ভর্তি নিল না। অনেক কষ্টকর তদবির করায় তারা কোন ডাক্তারের অধিনে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিলেন। চলে গেলাম ১০ তলায়। সেখানে কোন ডাক্তারের সিরিয়াল পাওয়া যায়নি। অনুরোধ করলে উল্টো রুক্ষ ব্যবহার করে। পরিচয় দিয়ে সবশেষে একটি সিরিয়াল ম্যানেজ করলাম। ৫ ঘন্টা অপেক্ষা করে কার্ডিও সার্জন কর্ণেল (অবঃ) কামরুল ইসলামের চেম্বারে মাকে নিয়ে প্রবেশ করে বললাম স্যার, আমার মা কোভিড নেগেটিভ, আমি পরীক্ষা করিয়েছি। মনে হয় তিনি বিশ্বাস করেননি।
৩ সেকেন্ড আমার মা এর রিপোর্ট দেখে তিনি সহকারীকে বললেন, উনাদেরকে কার্ডিও মেডিসিনের কাছে পাঠাও। আমি অনেক চেষ্টা করেও সেখানকার কোন কার্ডিও মেডিসিন ডাক্তারের সিরিয়াল পেলাম না। আবার নিয়ে গেলাম শ্যামলীতে অবস্হিত ন্যাশনাল হার্ট ইনস্টিটিউট এ। ওয়েব সাইডে এই প্রতিষ্টানের সুযোগ সুবিধার কথা পড়ে মনে হল এটি মনে হয় দেশের খুবই আধুনিক সুযোগ সুবিধার একটি হাসপাতাল। এখানে গেলেই আমার মা হয়ত বেঁচে যাবেন। যাওয়ার পথে ভিআইপি ট্রাফিক সিগন্যাল এ পড়ে গেলাম। ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ বড় বড় ভিআইপির আগমন ঘটবে তাই রাস্তা বন্ধ।
ট্রাফিক সার্জেন্টকে পরিচয় দিয়ে অনুরোধ করলাম আমার মুমুর্ষ মৃত্যুপথযাত্রী মা কে বহন কারী অটোরিক্সাটি ছেড়ে দিতে। তিনি বিনিতভাবে জানালেন, এ্যাম্বুল্যান্স হলে হয়ত ছাড়া যেত। এখন ছাড়লে পাবলিক ভাববে অন্য কিছু। নিরুপায় হয়ে আমি মাকে কালেমা পড়তে বললাম। মা পড়তে লাগল। আমি আর মা জপজপ ঘামতে লাগলাম। ব্যাক যাওয়ার সুযোগ নেই, পেছনে হাজার গাড়ির সারি।
৩ ঘন্টা পর মাকে নিয়ে হার্ট ইনস্টিটিউট পৌঁছি। জরুরি বিভাগের ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন মার বয়স কত? আমি বললাম সেভেন্টির কাছাকাছি। তিনি ভেংচি কেটে বললেন, এত বয়সে আরো বাঁচার জন্য এত চিকিৎসা করে কি হবে? এক বিঘত লম্বা দাঁড়ি ও টুপি জোব্বা পড়া এই ডাক্তারের কথা শুনে আমি হতভম্ব।
বিড়বিড় করে বললাম, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বয়স তো আরো বেশি। তিনি চিকিৎসার জন্য আসলেও কি আপনি এ কথা বলতেন? তিনি আমার প্রতিক্রিয়া বুঝতে পেরে আমাকে স্বাভাবিক করার জন্য বললেন, ককসবাজারে তো আমার বন্ধু ডাঃ সেলিম রেজা আছে। হার্ট বিশেষজ্ঞ, তাকে না দেখিয়ে এখানে আসছেন কেন?
মনে মনে বললাম, আপনি আমার মাকে চিকিৎসার প্রয়োজন দেখছেন না, আপনার বন্ধু তো মাকে ঊল্টো ঔষুধ দিয়ে মেরেও ফেলতে পারে। শত হলেও তো একই বনের হায়েনা আপনারা।
যা হোক, অনেক কষ্টে ৫০০ টাকা ঘুষ দিয়ে সিসিইউতে একটি সিট পেলাম। মাকে শুয়ালাম। ১০ মিনিট পর এক লোক এসে বলল আপনারা এই সিট হতে নেমে যান।
বললাম কেন? বলল, এই সিট আর এক মাহমুদা বেগমকে দেয়া হয়েছে। আপনার রোগির নাম মিলে যাওয়ায় ভুলে আপনাদেরকে দেয়া হয়েছে। বললাম আমি যে ৫০০ টাকা ঘুষ নিলেন যে? সে আমার কথা শুনতে নারাজ। যে ঘুষ নিয়েছে তাকে ডেকে আনল।
সে বলল, ওনি পুলিশের এএসপির মা। আমাকে একধাপ উপরে তোলে পরিচয় দেয়ার পরও আগের লোকটি হুংকার ছেড়ে বলল, এএসপি হয়েছে তো কি হয়েছে? এই বলে সে আমার প্রাণ যায় যায় অবস্হায় থাকা মাকে সিট থেকে নামিয়ে দিতে উদ্যত হলে আমি বিনিতভাবে বললাম, ভাই ঘুষ যত চাও তত দিব, আমার মাকে নামিয়ে দিওনা। তারপরও বেপরোয়া। ততক্ষণে আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল।
আমি তাকে বললাম- একটা লাথি মেরে ফুটবলের মত উড়িয়ে দেব। ১ সেকেন্ডের মধ্যে আমার মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে সরে যা। তারপর সে আস্তে আস্তে চলে গেল। ইংগিতে বুঝলাম, অপর রোগি হতে সে আরো বেশি নিয়েছে তাই এমন করছে।
মজার ব্যাপার হল, এই দৃশ্য অনেক ডাক্তার নার্সরা চেয়ে চেয়ে দেখলেও কেউ কিছু বলতে পারেনি বা বলেনি। পরিস্হিতি শান্ত হলে হঠাৎ আমার অফিস হতে ফোন বলা হয়, খুবই জরুরি ভিত্তিতে আদালতের একটি বিষয় নিয়ে কাল সকালেই আমার অফিসে আসতে হবে। সিদ্ধান্ত নিলাম, মা ছোট ভাগ্নির তত্ত্বাবধানে হাসপাতালে থাকুক। আমি রাতের গাড়িতে ককসবাজার যাব, কাজ সেরে সকালের ফাস্ট ফ্লাইটে ঢাকা মায়ের কাছে চলে আসব। সিদ্ধান্ত মতে সায়েদাবাদ এসে গাড়ির টিকেট কেটে গাড়িতে এক পা দিয়েছি উঠার জন্য। মোবাইল বেজে উঠল। দেখি ভাগ্নির কল। বলল, মা আমাকে খুঁজতেছে।
একদিকে চাকরি, অপর দিকে অসুস্হ মা। গাড়ি হতে নেমে গেলাম। গাড়ি ছেড়ে দেয়ায় টিকেট ফেরৎ না দিয়ে দ্রুত হাসপাতালে ফেরৎ আসি। যা হোক, রাতে আমার মায়ের অক্সিজেন ৯০তে নামলেও তারা অক্সিজেন দেয়নি। আমি ডিউটি ডাক্তার নার্সদের কেঁদে কেঁদে অনুরোধ করলেও তারা বিভিন্ন অযুহাতে অক্সিজেন দেয়নি। ককস সদর হাসপাতালে ইন্টার্নি ডাক্তাররা অন্তত ভাল ব্যবহার করেন। কিন্তু এখানে দেখলাম নার্স ডাক্তার সবাই খারাপ ব্যবহার করেন। নার্সরা তো সীমাহীন। মা সারারাত ঘুমাতে পারল না। বলল বাবা এখান থেকে আমাকে এক্ষুনি নিয়ে যাও। নইলে আজই আমি মরে যাব। তারপরও পরদিন সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। সকালে দেখলাম পাশের রোগির এন্টিবায়োটিক ইনজেকশন আমার মাকে পুশ করতেছে। আর আমার মায়েরটা পাশের রোগিকে। আমি না থাকলে দিয়েই দিত। তারপর আমি বন্ডসাইন দিয়ে মাকে রিলিজ নিয়ে প্রচন্ড গরমে আবার ছুটলাম অজানা উদ্ধেশ্যে। গাড়িতে মায়ের ছটপটানি দেখতে দেখতে ভাবলাম, দেশের স্বনামধন্য ৪/৫টি হাসপাতালের একটি হল ইবনে সিনা স্পেশালাইজড কার্ডিয়াক হাসপাতাল। সেখানে এলাকার ছোটভাই চাকরি করেন। তার হেল্প পেতে পারি। মাকে নিয়ে ছুটলাম সেখানে। তারপর সেখানে রচিত হল আমার জীবনের সবচেয়ে করুণ অধ্যায়। সেখানে গিয়ে মাকে বাইরের ফুটপাতে বসিয়ে জরুরি বিভাগে গিয়ে বললাম, মাকে ভর্তি করানোর জন্য। ডাক্তার জানালেন, কোন সিট খালি নেই। আমি বললাম এসব আমি শুনতে চাই না। তারা বিভিন্ন অযুহাত দেখাল। আমি হুমকি দিলাম। পরিচয়ও দিলাম। তারা বিভিন্ন জায়গায় কথা বলে কোভিড পরীক্ষার শর্তে নতুন সিট বসিয়ে একজন আনাড়ি কার্ডিয়াক ডাক্তারের অধিনে মা কে ভর্তি দেন। ডাক্তার দেখার পর বলল, সিসিইউ তে দেন। আমি বললাম আজ রাতটা দেখি। বলল, বন্ড সাইন দিতে হবে। দিলাম। পরের দিন রাত পর্যন্ত মা ভালই ছিল। কিন্তু কিছু খেতে পারে না। ঘুমাতে পারে না। রাতে মা বলল, বাবা তুমি আমার পাশে থাক। দুরে যেও না। বললাম ঠিক আছে মা। রাতে মাকে ১৭ বার এ কাঁত ও কাত করে শুয়ালাম। কিন্তু ঘুমাতে পারে না। রাত ২ টার সময় মা কফি খেতে চাইল। আমি মার জন্য আর আমার জন্য ২ কাপ কফি ও ১ পেকেট বিস্কুট নিয়ে আসলাম। মা ১টি বিস্কুট কফিতে চুবিয়ে সামান্য খেল। নার্স এসে বকা দিল আমাকে মাকে কফি খাওয়ানোর অপরাধে। মায়ের মঙ্গলের জন্যই হয়ত। তাই স্বাভাবিক ভাবেই নিলাম। রাত ২ টার পর মা সামান্য ঘুমায় আবার জেগে উঠে বলে, বাবা তুমি কোথাও একটু ঘুমাও। আমি না করি। কিছুক্ষণ পর পর আবার একই কথা। চিন্তা করলাম, আমি এখানে বসে থাকলে হয়ত আমি ঘুমাচ্ছি না এই চিন্তায় মায়ের ও ঘুম আসবে না। তাই ভাগ্নিকে মায়ের পাশে রেখে আমি হাসপাতালের নিচ তলার সিড়ির পাশের ফ্লোরে কখন যে শোয়ে পড়ে ঘুমিয়ে যাই তা বুঝতে পারিনি।
আল্লাহর কি কুদরত! আমি চলে যাওয়ার ১০ মিনিট পর নাকি আমার মায়ের মৃত্যু যন্ত্রণা শুরু হয়। কিন্তু আমি মনের অজান্তে মায়ের ঘুমের সুবিধার জন্য যেখানে শুয়ে পড়ি সেখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় ডাক্তার, নার্স আর আমার ভাগ্নি মিলে ২ ঘন্টায় শত শত বার কল করেও আমাকে পায়নি। পরে ভাগ্নির কাছে খবর পেয়ে আত্নীয় স্বজন সবাই আমার মোবাইলে শত শত কল দিয়েও আমাকে পায়নি। আমার মা তখন অন্তিম শয্যায় অর্ধচেতন। ২ ঘন্টা পর আমার ভাগ্নি জনে জনে খোঁজে আমাকে বের করে। আমি এসে দেখি মা এর হাতের শিরায় ডাক্তার ধারালো সূঁচ দ্বারা ঘাটাঘাটি করছে, কিন্তু মা নির্জীব। আমি বললাম, মাকে দ্রুত সিসিইউতে নেন। সিসিইউতে ঢুকানোর সময় মা আমাকে বলল, বাবা আমার জন্য তুমি এত টাকা কেন ঢালতেছ! এই ছিল মায়ের সাথে আমার শেষ কথা।
আমি বললাম, মা আমার তেমন কোন টাকা খরচ হচ্ছে না। তুমি এগুলো নিয়ে চিন্তা কর না। শুধু কালেমা পড়। মা কালেমা পড়তে পড়তে সিসিইউতে ঢুকল। আমি বাইরের ওয়েটিং রুমে মায়ের ভাল সংবাদের জন্য তীর্তের কাকের মত অপেক্ষা করতেছি।
মাইকে মাহমুদা বেগমের এটেন্ডেন্টকে ডাকলেই লাফ দিয়ে দৌঁড়ে যাই, এই বুঝি আমার মা চোখ খুলল। কিন্তু প্রতিবারই ভিতরে গিয়ে শুনতে পাই, অবস্হা আগের চেয়ে খারাপ। প্রতিবারই যেন কলিজার ভেতর ভুমিকম্প নিয়ে অসহায় হয়ে ওয়েটিং রুমে ফিরে আসি। এভাবে ৪ দিনে প্রায় ৫০ বার ডেকেছে, প্রতিবারই হৃদয়ে রক্তক্ষরণ নিয়ে ফিরে এসেছি। অসংখ্য বার চোখের পানিতে হাসপাতালের মসজিদের কাপের্ট ভিজিয়ে মাকে আল্লাহর কাছে ভিক্ষা চেয়েছি। কিন্তু আমার পাপ এত বেশি যে, ——–!
যা হোক, শুক্রবার সবাই জুমার নামাজে যাই। ফিরে এসে শুনি, মা সিসি ইউতে হার্ট স্ট্রোক করেছে। ডাক্তারের কাছে জানকে চাইলাম, কেন স্ট্রোক করল? ডাক্তার বলল, প্রয়োগকৃত ঔষুধের ইম ব্যালেন্সের কারণে। বললাম, ঔষুধ তো আমি প্রয়োগ করতেছি না। আপনারা প্রয়োগ করতেছেন, তাহলে ইমব্যালেন্স হবে কেন? বলল, উনার মেটাবলিজস, আর কিডনি ফাংসান কাজ করছে না। প্রসাব হচ্ছে না। দোয়া করেন আমরা চেষ্টা করছি। শুক্রবার সন্ধ্যায় ডাক্তার জানাল যে, আমার মা আবার স্ট্রোক করতে পারে। তখন আর বাচাঁনো যাবে না। বললাম করনীয় কি? বলল, লাইফ সাপোর্ট। বললাম, লাইফ সাপোর্ট হতে উঠে আসার সম্ভাবনা কতটুকু? বলল, আল্লাহর হুকুম থাকলে ২%। বললাম, . ০১% সম্ভাবনা থাকলেও দেন। যাতে আমার কোন আপসোস না থাকে যে, লাইফ সাপোর্ট হতে মনে হয় আমার মা উঠে আসত। আমি চোখের পানিতে ভিজিয়ে স্বাক্ষর করলাম। তারপর আমার মৃত মাকে তারা চুড়ান্ত কষ্ট দিয়ে লাইফ সাপোর্ট দিল।
প্রকৃতপক্ষে শুক্রবার বিকেলে আমার মা বিদায় নেয়। তখন আমরা কেউ পাশে ছিলাম না। কারণ ইবনে সিনায় নার্সরা খারাপ ব্যবহার না করলেও অত্যন্ত রুক্ষ আর নিষ্ঠুর। তারা শেষবারের মত আমাকে মা বলেও ডাকতে বাঁধা দেয়। মাকে ছুঁয়ে দেখতে দেয় না, লাইফ সাপোর্টের আগে হেলান দেয়া মাকে খুব সুন্দর অনেকটা রানির মত লাগছিল। ছবি তুলতে চাইলাম, রুঢ় ব্যবহার করল। বস্তা বস্তা ঔষুধ কিনে দিয়েছি। সব টেস্ট নতুন করে করেছি তাতে লক্ষ টাকা খরচ করে কিছুই হল না। বন্ধুরা অনেকে টাকা পয়সা ধার দিয়ে সহযোহিতা করেছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। যা হোক, শুক্রবার দিবাগত ভোরে তারা বলল, আমার অনুমতি পেলে তারা লাইফ সাপোর্ট খোলে মাকে ডেড ঘোষনা করতে চায়।
আমি বললাম, মৃতকে জীবিত বলে লক্ষ লক্ষ টাকা খুইয়ে এর চেয়ে ভাল আপনারা আর কি বলবেন। তারপর হিমশীতল মায়ের কপালে হাত রেখে আমি যেন পৃথিবী নামক গ্রহটিকেই ভুলে গেলাম।
মনে মনে আল্লাহকে বললাম, “হে আল্লাহ, আমার মা যাদের কারণে চিকিৎসা বঞ্চিত হল তাদের বিচার তুমার কাছেই দিলাম। কারণ এই পৃথিবীতে সেটি কোন অপরাধই নয়।”
তারপর সব নাটকের যবনিকাপাট ঘটল। মাকে প্যাকিং করা হল। সেই সাথে প্যাকিং হল আমার জীবনের সব শখ, স্বপ্ন, সাধ, আহলাদ, বেচে থাকার সকল প্রেরণা আর সমস্ত ভাললাগা।
এখন আমি এক অপদার্থ, অযোগ্য, আর ব্যর্থ, সন্তান নামের কলংক। অথচ এমন মা কেই আমার মত সন্তানই হত্যা করে কুচি কুচি করে কেটে হাই কমোডে ঢেলে ফ্লাস করে দেয়।
মায়ের এই মৃত্যু পূর্ব ১ মাসের যন্ত্রণা হয়ত আমাকে সারা জীবন স্বাভাবিক হতে দিবে না। আজ বিবেকের দংশনে আমি জর্জরিত।
শাকের আহমেদ
পরিদর্শক
টুরিস্ট পুলিশ, কক্সবাজার।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।